ধূর্ত মোহনদাস গান্ধী ও
ডক্টর আম্বেদকরঃ
গান্ধীজীঃ ওহ,ডক্টর আম্বেদকর,আসুন।
আম্বেদকরঃ অস্পৃশ্য সমাজের ব্যাপারে আপনি কথা
বলতে চেয়েছিলেন।
গান্ধীজীঃ আপনি কিন্তু ভারতের পিছিয়ে পড়া এবং অস্পৃশ্য
সমাজকে বিভ্রান্ত করছেন।
আম্বেদকরঃ বিভ্রান্ত করছি না।সঠিক পথ দেখাছি।
গান্ধীজীঃ সঠিক পথ কী আমরা দেখাচ্ছি না?
আম্বেদকরঃ না।
গান্ধীজীঃ সমস্ত
ভারতবাসী আমার সন্তান।কাউকে আমি বঞ্চিত হতে দেব না।আমি আর আমার কংগ্রেস এ ব্যাপারে
দায়বদ্ধ।
আম্বেদকরঃ আপনি আর আপনার কংগ্রেস জাতিভেদ এবং
অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
গান্ধীজীঃ কংগ্রেস তহবিল থেকে অস্পৃশ্য সমাজের উন্নতির
জন্য আমি ২০ লক্ষ টাকা খরচ করেছি।অস্পৃশ্য পল্লীতে গিয়ে আমি রাত কাটাচ্ছি,তাদের
সাথে থাকছি,তাদের সাথে খাচ্ছি।তাদেরকে আমি ‘হরিজন’ আখ্যা দিয়েছি।
আম্বেদকরঃ এতো রাজনীতি,আপনার দেখে কী হিন্দুরা
অস্পৃশদের আপন করেছে না করছে?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনার যখন জন্ম হয়নি তখন থেকে
আমি অস্পৃশ্য সমাজের জন্য কাজ করছি।
আম্বেদকরঃ আপনার কি মনে হয়?অস্পৃশ্যতার
ব্যাপারে হিন্দুদের মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়েছে?
গান্ধীজীঃ সময় লাগবে।
আম্বেদকরঃ হাজার বছর পার হলেও হবে না।
গান্ধীজীঃ আপনি এমন কেন বলছেন?
আম্বেদকরঃ কারণ অনেক মনীষী অস্পৃশ্যতাকে পাপ
বলেছেন,অস্পৃশ্যদের সাথে ছোঁয়া-ছুঁয়ি করেছেন।শেষে গঙ্গাজলে স্নান করে সমস্ত পাপ
ধূয়ে ফেলেছেন।তাতে অস্পৃশ্যদের কি লাভ হল?লাভ হল তো সেই মনীষীর।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি আমার কাজকে
ধান্দাবাজি বলছেন?
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,আমি বাস্তবটাই বললাম।
গান্ধীজীঃ গোঁড়া হিন্দুদের হাত থেকে বাঁচাতে আমি তাদের
হরির অংশ বলে পরিচয় দিয়েছি।একি ধান্দাবাজি?
আম্বেদকর্ঃ ভারতের বড় বড় সাধু সন্তরা মানুষ
হিসাবে সবাই সমান বলতে পারেননি।তাঁরা বলেছেন ঈশ্বরের কাছে সবাই সমান।মানুষ হিসাবে
সবাই সমান বলা যাচ্ছে না কেন?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি তাহলে কি চান?
আম্বেদকরঃ আমি চাই সংস্কার।
গান্ধীজীঃ সামাজিক সংস্কার তো কংগ্রেস চালাচ্ছে।
আম্বেদকরঃ সমাজ পরিচালিত হচ্ছে ধর্মের বিধানে।তাই
প্রকৃত সমাজ সংস্কার করতে হলে,সমাজ থেকে জাতিভেদ নির্মূল করতে হলে ধর্মকেও সংস্কার করতে হবে।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আমি মনে করি জাতিভেদ ও
অস্পৃশ্যতা সম্পূর্ণ সামাজিক ব্যাধি।এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,আপনি সত্যকে অস্বীকার করছেন।
গান্ধীজীঃ আমি একথা কিছুতেই মানবো না যে জাতব্যবস্হার সাথে
ধর্মের সম্পর্ক আছে।
আম্বেদকরঃ আপনি স্বীকার না করলে কি জাতিভেদের
বিধান ধর্মগ্রন্থ থেকে মুছে যাবে?
গান্ধীজীঃ আমি জানি
আপনি ধর্মশাস্ত্রগ্রন্থ থেকে প্রচুর প্রমান জড়ো করেছেন যেখানে জাতব্যবস্হার ধর্মীয়
নির্দেশ আছে।আমি এগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করি।
আম্বেদকরঃ যদি প্রক্ষিপ্ত অংশ হয় তাহলে
ধর্মশাস্ত্র থেকে তা বাদ দেওয়া হচ্ছে না কেন?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আমি জাতব্যবস্হা নয়,বর্ণব্যবস্হাকে
হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করি।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,জাতব্যবস্হা আর
বর্ণব্যবস্হার মধ্যে বাস্তবে কোন তফাৎ আছে কি?
গান্ধীজীঃ অবশ্যই
আছে।জাতব্যবস্থা সমাজগত কিন্তু বর্ণব্যবস্থা ধর্মগত।
আম্বেদকরঃ সমাজে কিন্তু জাত আর বর্ণ একই অর্থে
ব্যবহৃত হচ্ছে।
গান্ধীজীঃ মানুষ
ভুল করছে।
আম্বেদকরঃ সাধারণ মানুষ কি জানে ধর্মগ্রন্থে
কোনগুলি আসল আর কোনগুলি প্রক্ষিপ্ত?বংশগত রোগের মত জাতিভেদ বংশগতিতে বাহিত হচ্ছে।জাত-ব্যবস্হা
বংশ পরম্পরায় চলে আসছে ধর্মের অংশ হিসাবে।জাত-ব্যবস্হার নামটা শুধু বর্ণ-ব্যবস্হায় পরিবর্তিত হয়েছে।বাস্তবে
জাত আর বর্ণের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।
গান্ধীজীঃ ডক্টর
আম্বেদকর,বর্ণ ও বর্ণাশ্রম ধর্মীয় বিধি,যার সাথে জাতের কোন সম্পর্ক নেই।
আম্বেদকরঃ জঘণ্য জাতব্যবস্হাকে যে উদ্দেশ্যে
ধর্ম বানানো হয়েছিল,সেই একই উদ্দেশ্যে বর্ণ-ব্যবস্হাকেও ধর্ম বানানো হয়েছে।বাস্তবে
জাত-ব্যবস্হার সাথে বর্ণব্যবস্হার শুধুই নামেই তফাৎ,কাজ একই।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর, আমি বর্ণব্যবস্হাকে মহান বলে
মনে করি।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,বর্ণব্যবস্হা মহান কিসে?
গান্ধীজীঃ বর্ণব্যবস্হা
আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে আমাদের প্রত্যেককেই আমাদের পৈতৃক পেশাকে জীবিকা হিসাবে
গ্রহন করতে হবে।এটা আমাদের কর্তব্য।তা হলে সমাজে পেশাগত কোনো সমস্যা থাকবে না।
আম্বেদকরঃ মানে আপনি বলতে চাইছেন প্রত্যেক
হিন্দুকে তার বংশগত বা পিতৃপুরুষের পেশা গ্রহন করতে হবে?এটাই তার ধর্ম?
আম্বেদকরঃ পৈতৃক পেশা গ্রহন করাই যদি পবিত্র
ধর্মীয় কাজ হয় তাহলে শিক্ষার কি দরকার?পুরোহিতের সন্তান পুরোহিত হবে,মুচির সন্তান
মুচির কাজ করবে,মেথরের ছেলে মেথরের কাজ করবে,কুমোরের ছেলে কুমোর হবে,বারবণিতার
সন্তান বারবনিতা হবে।একি প্রগতিশীল পদ্ধতি?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি
খুব যুক্তিবাদী।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,আপনি বর্ণব্যবস্হাকে মহান
বলে বর্ণপ্রথার যে সংজ্ঞা দিচ্ছেন তা তো জাত-ব্যবস্হাকে বোঝাচ্ছে।
গান্ধীজীঃ মোটেই না।
আম্বেদকরঃ বর্ণের বৈদিক ব্যাখা হল মানুষের
বর্ণ তার প্রকৃতিগত গুনাবলীর দ্বারা নির্নীত হবে।আর আপনি বলছেন পিতৃপুরুষের পেশা
গ্রহন করাই বর্ণধর্ম।আপনি জন্মগত জাত-ব্যবস্হাকে ঘুরিয়ে বর্ণব্যবস্হা বলছেন না কী?
গান্ধীজীঃ আমার তা মনে হচ্ছে না।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,আপনি
যদি বলেন পিতৃপুরুষের পেশাগ্রহন করা পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য তাহলে আপনি কিন্তু
জন্মগত জাত-ব্যবস্হাকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
গান্ধীজীঃ মোটেই
না।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,আপনি কিন্তু জাতের
ছদ্মনামে বর্ণকে সমর্থন করতে গিয়ে জনগনকে প্রতারিত করছেন।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,গীতাকে আমি পরম
পবিত্র গ্রন্থ হিসাবে মানি।বর্ণপ্রথাকে খারাপ বলতে পারি না।
আম্বেদকরঃ আপনার
কথায় বর্ণ আর জাত সমার্থক হয়ে যাচ্ছে।অথচ আপনি বর্ণপ্রথাকে পৃথক এবং মহান করে
দেখাতে মরিয়া কেন?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,বর্ণব্যবস্হা
পিতৃপুরুষের পেশাভিত্তিক হলে সমাজে আর পেশাগত সমস্যা থাকবে না।
আম্বেদকরঃ জাত-ব্যবস্হার
শর্ত তো এটাই ছিল যে জাতের মানুষ তার নিজ জাতের কাজ করবে।তাহলে জাত আর বর্ণ-ব্যবস্হা
আলাদা কোথায়?আর মহান কিসে?
গান্ধীজীঃ ডক্টর
আম্বেদকর,ব্রাহ্মণের পেশা আর মল-মূত্র পরিস্কারকারী মেথরের পেশা সমান মর্যাদা
সম্পন্ন।ঈশ্বরের কাছে দুটি সমগুন সম্পন্ন।
আম্বেদকরঃ ঈশ্বরের কাছে,মানুষের কাছে নয় তো?
গান্ধিজীঃ বর্ণব্যবস্থাকে
সমাজের কিছুলোক বিকৃত করছে।তার জন্য বর্ণ-ব্যবস্হাকে দোষারোপ করা ভুল।বর্ণ-ব্যবস্হায়
অস্পৃশ্যতা বলে কিছু নেই।
আম্বেদকরঃ বর্ণ-ব্যবস্হাকে যারা বিকৃত অর্থ
করছে তাদের শাস্তির বিধান আছে কী?
গান্ধীজীঃ না।তা নেই।
আম্বেদকরঃ জাত-ব্যবস্হায় কিন্তু শাস্তির বিধান
ছিল।আর তা ছিল ঈশ্বরের বিধানের নাম করে।বর্ণব্যবস্হায় ঈশ্বর এত অহিংস
কেন?বুদ্ধদেবের চাপে পড়ে কী?
গান্ধীজীঃ দেখুন
ডক্টর আম্বেদকর,আপনি আমাকে যতই কথার জালে জড়াবার চেষ্টা করুন আমি কিন্তু ৫০টি বছর
যে ধারনা নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি বাকীটা জীবন সেই ধারনায় কাটিয়ে দেবো।
আম্বেদকরঃ তাহলে আপনি সংস্কারে রাজি নন?
গান্ধীজীঃ আমার কংগ্রেস সামাজ সংস্কারের কাজ তো চালিয়ে যাচ্ছে।
আম্বেদকরঃ শুধুই
সমাজ সংস্কার করলে হবে?ধর্ম সংস্কার করতে হবে না?
গান্ধীজীঃ ধর্ম
সংস্কারের কোন প্রয়োজন নেই।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,সমাজ পরিচালিত হচ্ছে
কিন্তু ধর্মের বিধান মত।জাতব্যবস্হা বা বর্ণ-ব্যবস্থার রীতিনীতি কিন্তু মানুষ
ধর্মগ্রন্থের বিধান অনুযায়ী পালন করে।আর হিন্দুরা জাত-ব্যবস্হার ক্রীতদাস।তারা জাত-ব্যবস্হা
ভাঙতে চায় না।সমাজে জাত আর বর্ণ কিন্তু একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।
গান্ধীজীঃডক্টর আম্বেদকর,তার জন্য ধর্মকে দোষ
দেওয়া চলে না।সনাতন ধর্মের বর্ণ-ব্যবস্হাকে আমি শ্রদ্ধা করি।
আম্বেদকরঃ আপনার কাল্পনিক বর্ণ-ব্যবস্হার প্রতি
প্রেমের অর্থ হল জঘণ্য জাত-ব্যবস্হাকে আরো বেশী আঁকড়ে থাকা,আরো বেশী মজবুত করা।
গান্ধীজীঃ আমি মানতে পারলাম না।
আম্বেদকরঃ আপনি
বর্ণ-ব্যবস্হার কাল্পনিক তত্ত্বের দ্বারা সমাজ বিভক্ত করে রাখতে চাইছেন এবং সমাজ
সংস্কারের কাজে বাধা দিচ্ছেন।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি ঠিক বলছেন না।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,বর্ণ-ব্যবস্হাকে
বজায় রেখে অস্পৃশ্যতা দূর করার প্রচেষ্টা হল কোন ব্যাধির মূলোৎপাটন না করে উপর
থেকে মলম লাগানোর মত।
গান্ধীজীঃ আমি
অস্পৃশ্যদের জন্য কিছু করি নাই?
আম্বেদকরঃ হ্যাঁ।তাদের সেবা করছেন।কিন্তু মুক্তির
পথ দেখাচ্ছেন না।
গান্ধীজীঃ আমি বর্ণ-ব্যবস্হাকে খারাপ বলি
না।আমি জাত-ব্যবস্হা ও অস্পৃশ্যতাকে ঘৃণা করি এবং অস্পৃশ্যতা দূর করবোই।
আম্বেদকরঃ আগে অস্পৃশ্যতার উৎস ছিল জাতব্যবস্হা
আর এখন হয়েছে বর্ণব্যবস্হা।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,বর্ণ-ব্যবস্হা না
থাকলে সমাজ কিন্তু ভেঙে পড়বে।
আম্বেদকরঃ আপনার বর্ণ-ব্যবস্হা ফুটো পাত্রের
মত।বর্ণব্যবস্হা কখনো নিজের ধর্ম রক্ষ্যা করতে পারে না এবং তা শেষ পর্যন্ত জাত-ব্যবস্হায়
পর্যবসিত হতে বাধ্য।কারণ বর্ণ-ব্যবস্হা ভঙ্গকারীদের কোন শাস্তির বিধান নেই।
গান্ধীজীঃ আপনি কি বলতে চান চৈতন্যদেব,জ্ঞানদাস,তুকারাম,রামকৃষ্ণদেব,রামমোহন,মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথ,বিবেকানন্দ যে ধর্ম অনুসরন করেছেন সে ধর্ম সংস্কারের প্রয়োজন আছে?
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,এমন মহান ব্যক্তি ও
সাধু সন্ত অনেক এসেছেন,আবার চলে গেছেন।কিন্তু জাত-ব্যবস্হা ও অস্পৃশ্যতা তো যেমন
ছিল তেমন আছে।এরা কি জাত-ব্যবস্হার বিরুদ্ধে কখনো জেহাদ ঘোষনা করেছেন?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি হিন্দুধর্মের
মধ্যে লালিত পালিত হয়েছেন এবং হিন্দুরাজার অর্থ সাহায্যে উচ্চ শিক্ষা লাভ
করেছেন।তাসত্ত্বেও হিন্দুধর্মের সমালোচনা করছেন?
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,যাঁরা আমাকে সাহায্য
করেছেন তাঁদের মধ্যে কিন্তু কেউ ব্রাহ্মণ্যবাদী নন।আমার লড়াই ব্রাহ্মণ্যবাদের
বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ বা হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে নয়।আর আলোচনা-সমালোচনা করে দোষ ত্রুটি
সংশোধন করা শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য।
গান্ধীজিঃ কিন্তু আমার মতে হিন্দুধর্মের
সংশোধনের প্রয়োজন নেই।
আম্বেদকরঃ কেউ যদি বলে ধর্মের সংশোধনের
প্রয়োজন নেই তাহলে সেই ব্যক্তি ধর্ম ও সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু।হিন্দুধর্মের
ক্ষেত্রে এটি বেশী প্রমানিত।
গান্ধীজীঃ একথা আমি মানি না।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,গীতাকে সম্মান জানাতে গিয়ে
যারা বর্ণপ্রথাকে মহান দেখাতে মরিয়া তারা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক সেই জাত-ব্যবস্হাকে
শক্ত করছেন।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনার সাথে আমি একমত
নই।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,আমি জানি ভারতের দীর্ঘদিনের
জঘণ্য ধর্মীয় ব্যাধি জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতাকে খতম করতে পারে দুজন-এক কংগ্রেস আর এক ইংরেজ।
গান্ধীজীঃ শুধুই
কংগ্রেস,ইংরেজ নয়।
আম্বেদকরঃ কংগ্রেস কী করবে?কংগ্রেসের মাথা যখন
রাজি নয়।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি আমার উপর ভরসা
রাখুন।
আম্বেদকরঃ কত বছর?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি ভারতের পিছিয়ে
পড়া শ্রেনী এবং অস্পৃশ্য সমাজের নেতা হতে চাইছেন কেন?
আম্বেদকরঃ কারন আমি সেই সমাজের একজন।আমি নেতা
হতে চাইছি না।আমি তাদের মুক্তি চাইছি।
গান্ধীজীঃ আপনি তো
ব্রাহ্মন?
আম্বেদকরঃ না।আমি ব্রাহ্মণ নই।আপনাদের জাত-ব্যবস্হায়
আমি অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায়ের মানুষ।
গান্ধীজীঃ আমি তো আপনাকে পূণার অগ্রগন্য ব্রাহ্মণ
বলেই জানতাম।দুঃখিত।
আম্বেদকরঃ ঠিক আছে।সমাজের বেশীর ভাগ মানুষের
ধারনা তাই।উচ্চশিক্ষিত মানুষ মানেই ব্রাহ্মণ।ধারনা অমূলক নয়,কারণ শিক্ষার অধিকার
কেবল ব্রাহ্মণের ছিল।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আপনি উচ্চশিক্ষিত
মানুষ।আপনি পড়াশুনা নিয়ে থাকুন।সমস্ত ভারতবাসী আমার সন্তান।আমি স্পৃশ্য ও অস্পৃশ্য
সবার নেতা।
আম্বেদকরঃ না গান্ধীজী,আপনি স্পৃশ্য ও
কংগ্রেসের নেতা।আপনি ভারতের পিছিয়ে পড়া শ্রেনী ও অস্পৃশ্য সমাজের নেতা নন।
গান্ধীজীঃ আমি ও আমার কংগ্রেস এ বিষয়ে আপ্রান
চেষ্টা করছি।আর কাউকে এ ব্যাপারে না ভাবলে চলবে।
আম্বেদকরঃ ভারতের পিছিয়ে পড়া শ্রেনী ও
অস্পৃশ্য সমাজ রাজনীতির শিকার।তাদের নিয়ে কেবল রাজনীতি হচ্ছে।
গান্ধীজীঃ আপনি কি চান?
আম্বেদকরঃ আপনি যখন সংস্কারে রাজি নন এবং
জাতিভেদের দুর্গন্ধ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে রাজি নন তখন আমাকে নিজেই লড়তে হবে।
গান্ধীজীঃ আপনার মর্জি।
আম্বেদকরঃ গোলটেবিল বৈঠকে ব্রিটিশ
প্রধানমন্ত্রী অস্পৃশ্য শ্রেণীর জন্য যে পৃথক ভোটাধিকারের অধিকার দিলেন সে বিষয়ে
আপনার অভিমত কী?
গান্ধীজীঃ ভারতের পিছিয়ে পড়া শ্রেণী ও
অস্পৃশ্যদের পৃথক ভোটাধিকা্র আমি মেনে নেব না।তাদের আমি হিন্দুধর্ম থেকে আলাদা হতে
দেব না।হিন্দুধর্মের এতবড় ক্ষতি আমি মেনে নেব না।
আম্বেদকরঃ হিন্দুধর্মের ক্ষতি কোথায়
হচ্ছে?তারা তো ধর্মচ্যূত হচ্ছে না।তারা ক্ষমতা পাবে।মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে।
গান্ধীজীঃ আমি মুসলীম,খ্রীষ্টান,শিখদের পৃথক
ভোটাধিকার মানতে পারি কিন্তু পিছিয়ে পড়া শ্রেণী ও অস্পৃশ্যদের পৃথক ভোটাধিকার
মানতে পারি না।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,আপনি জঘণ্য
জাতব্যবস্হার ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও অস্পৃশ্য শ্রেণীর মুক্তি চান না?আপনি কী চান
তারা এখনো জাত-ব্যবস্হার ক্রীতদাস হয়ে থাক?
গান্ধীজীঃ তা কেন?
আম্বেদকরঃ আপনি জাত-ব্যবস্হার গোড়া কাটতে
চাইছেন না।মানে
ধর্মীয় সংস্কার চাইছেন না।নিপীড়িত মানুষ মুক্তি পাক চাইছেন না।তারা ক্ষমতা পাক
চাইছেন না।আপনার কথা বিভ্রান্তিকর নয় কী?
গান্ধজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আমি হিন্দুধর্মের ক্ষতি চাই না।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,ক্ষতি না চেয়ে আপনি বড়
ক্ষতি করছেন না কী?আপনি শুধু ধর্মের কথা ভাবছেন?দীর্ঘকাল ধরে যে মানুষ গুলো জঘণ্য
জাত-ব্যবস্হার ফলে নিপীড়িত,শোষিত,বঞ্চিত হয়ে দাসের মত করুন জীবন কাটাচ্ছে তাদের
কথা ভাববেন না?
গান্ধীজীঃ ভাবছি
তো।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,অনেকেই আপনার মত এমন ভেবে
ভেবে চলে গেছেন।সমস্যা তো তেমনই রয়ে গেছে।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,অধৈর্য্য হলে হবে না।আমাদের ধৈর্য্য ধরতে
হবে।
আম্বেদকরঃ অস্পৃশ্যরা যাতে পৃথক ভোটাধিকারের
অধিকার না পায় এবং মুসলীম লীগ যাতে আমাকে সমর্থন না করে সেজন্য আমাকে আটকাতে আপনি
মুসলীম লীগের সাথে গোপন পরামর্শ করে তাদের ১৪দফা দাবী মেনে নিলেন?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,আমার বিরুদ্ধে
অভিযোগটি মিথ্যা।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,মুসলীম লীগ নেতারাই
সে কথা স্বীকার করেছে।
গান্ধীজীঃ আমি জান না।
আম্বেদকরঃ আপনি কিভাবে অস্পৃশ্যদের পৃথক
ভোটাধিকার অস্বীকার করবেন?
গান্ধীজীঃ আমার
ব্রক্ষাস্ত্র প্রয়োগ করবো।আমি আমৃত্যূ অনশনে বসবো।
আম্বেদকরঃ দেশবাসীর সামনে আমাকে ভিলেন বানাতে
চান?
গান্ধীজীঃ না।আমি কিন্তু আপনাকে দেশপ্রেমিক বলে
থাকি।গোলটেবিল বৈঠকে আমি সে কথাই বলেছি।
আম্বেদকরঃ আপনার কংগ্রেস কিন্তু আমাকে
দেশদ্রোহী বানাতে মরিয়া।
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর আমি আছি।
আম্বেদকরঃ আপনি অনশনে বসে কি করতে চান?
গান্ধীজীঃ আপনি অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক
ভোটাধিকার ছেড়ে দিলে আমি নির্বাচনে অস্পৃশ্যদের জন্য অনেক আসন সংরক্ষণ করবো।আপনি
রাজি না হলে আমি অনশনে প্রাণ ত্যাগ করবো।
আম্বেদকরঃ দীর্ঘ লড়ায়ের ফলে অস্পৃশ্য সমাজের
মুক্তির জন্য যে অধিকার আমি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে আদায় করলাম তা আপনি কেড়ে নিতে
চান?তাও আবার মানুষকে খেপিয়ে?
গান্ধীজীঃ ডক্টর আম্বেদকর,হিন্দুধর্মের
স্বার্থে আমাকে একাজ করতেই হবে।আর মানুষ খেপিয়ে কেন বলছেন?
আম্বেদকরঃ আমার জন্য আপনি অনশনে মৃত্যূবরণ
করবেন আর আপনার অস্পৃশ্য বিরোধি হিন্দুসমাজ আমাকে মহান বলবে?এমনিতে তারা সর্বসময়
আমার মৃত্যূ কামনা করছে।
গান্ধীজীঃ এসব গোঁড়া হিন্দুদের কাজ।
আম্বেদকরঃ অনশনের নামে আপনি কি দেশের অস্পৃশ্য
বিরোধি হিন্দুসমাজকে আমার উপর লেলিয়ে দিচ্ছেন না?
গান্ধীজীঃ ডক্টর,আম্বেদকর,আপনার
আশংকা অমুলক।
আম্বেদকরঃ গান্ধীজী,পৃথক ভোটাধিকার পেলে
স্পৃশ্যরা অন্ততঃ ভোট পাওয়ার জন্য অস্পৃশ্যদের আপন করবে আর অস্পৃশ্যরা নিজেদের
সমাজের প্রার্থী নির্বাচন করলে তারা সবক্ষেত্রে ক্ষমতা পাবে।আপনি এটা কেন চাইছেন
না?
গান্ধীজীঃ ডক্টর
আম্বেদকর,এতে হিন্দুধর্মের মধ্যে ভাঙন স্পষ্ট হবে।
আম্বেদকরঃ আপনি অস্পৃশ্যদের পৃথক ভোটাধিকার
কেড়ে নেওয়ার জন্য অনশন না করে যদি হিন্দুধর্ম থেকে জাত-ব্যবস্হা বা বর্ণ-ব্যবস্হা
এবং অস্পৃশ্যতা দূর করতে অনশন করেন তবে দেশ ও দশের মঙ্গল হয়।
গান্ধীজীঃ ডক্টর
আম্বেদকর,আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি আমৃত্যূ আমার অস্পৃশ্য ভাই-বোনের জন্য লড়ে
যাব।
আম্বেদকরঃ তার মানে আপনি অস্পৃশ্যদের
অস্পৃশ্যতার মুক্তি চান না,তাদের দীর্ঘ অস্পৃশ্য জীবন চান।যাতে আপনি আমৃত্যূ তাদের
জন্য কাজ করতে পারেন।
গান্ধীজীঃ ডক্টর
আম্বেদকর,আমার ভজনের সময় হল।
আম্বেদকরঃ ঠিক আছে,আমি আসছি।তবে মনে রাখবেন,ইতিহাস
বিচার করবে।
@Prasanta
Kumar Mondal
No comments:
Post a Comment