শ্রাদ্ধকার্য কিন্তু বেদ,উপনিষদ ও গীতা বিরোধিঃ
|
ঃশ্রাদ্ধ নয়, শ্রদ্ধা অনুষ্ঠান করুনঃপ্রশান্ত
কুমার মণ্ডল
যাদের
স্বর্গ,নরক,জন্মান্তরবাদ,আত্মা ও প্রেত্মায় অন্ধবিশ্বাস আছে তাদেরও মৃত ব্যক্তির
জন্য শ্রাদ্ধ করা উচিত নয়।কারণ বেদ,উপনিষদ ও গীতার দর্শন অনুযায়ী শ্রাদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই।
বেদ,উপনিষদ ও
গীতার দর্শন অনুযায়ী আত্মা অমর,অব্যয় ও অবিনশ্বর।আত্মাকে কাটা যায় না,জলে সিক্ত
করা যায় না ও আগুনে পোড়ানো যায় না।আত্মাকে কোনো ভাবেই ধ্বংস বা ক্ষতি করা যায়
না।মৃত্যূর পর আত্মা কর্মফল অনুযায়ী নতূন দেহ ধারন করে।এভাবে অনেকবার জন্ম মৃত্যূর
মধ্য দিয়ে কর্মফল খন্ডনের পর আত্মা পরমভ্রহ্মে মিশে যায়।এটাই জন্মান্তরবাদ।অর্থাৎ এজন্মের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি পূর্বজন্মের পাপপূন্যের ফল বলে মানতে হবে।ব্রাহ্মন্যবাদী শাস্ত্রকাররা এটাকে ঈশ্বরের বিধান বলে ঘোষনা করেছেন।তাহলে বেদ,উপনিষদ ও গীতার দর্শন এবং জন্মান্তরবাদের থিওরি অনুযায়ী মৃত
ব্যক্তির জন্য শ্রাদ্ধের তো প্রয়োজন নেই।অর্থাৎ জন্মান্তরবাদে
আত্মার জন্য কিছুই করার দরকার নেই।অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির
জন্য শ্রাদ্ধ করা মানে বেদ,উপনিষদ ও গীতাকে অপমান করা বা অস্বীকার করা।
তাহলে বেদ,উপনিষদ ও গীতা বিরোধি শ্রাদ্ধ এলো কিভাবে?ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের লোভ-লালোসা থেকে শ্রাদ্ধের জন্ম।অন্যের সম্পদ লুঠ করার লোভ-লালোসা থেকে
শ্রাদ্ধের উৎপত্তি।
যেমন করে ব্রাহ্মণ
সম্প্রদায় বেদের মন্ত্রের অপব্যাখা করে সতীদাহ প্রথার নামে বিধবা নারীদের
পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেছিলো এবং হাজার হাজার নারীকে পুড়িয়ে মেরেছিলো ঠিক তেমনি
ভাবে বেদের কথার অপব্যাখা করে শ্রাদ্ধের জন্ম দিয়েছে।বেদে আত্মার অন্য দেহ গমনের
কথাকে ব্রাহ্মণরা নিজেদের
স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভিন্ন অর্থ করেছে।এরা প্রচার করলো মৃত্যূর পর আত্মা প্রেতদেহে
প্রবেশ করে এবং শ্রাদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত প্রেতদেহে নরকযন্ত্রনা ভোগ করে।শ্রাদ্ধ
হলে এবং ব্রাহ্মণের থলি ভর্তি হলেই আত্মা প্রেত দেহ ছেড়ে স্বর্গে যাত্রা করে।
ব্রাহ্মণদের এই
মতবাদ বেদ,উপনিষদ ও গীতার কর্মফল অনুযায়ী জন্মান্তরবাদ বিরোধি নয় কী?ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় মিথ্যা
শাস্ত্র রচনা করে মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে সুকর্ম-কুকর্ম,পাপপূন্য যাই করো না
কেন শ্রাদ্ধ না করলে আত্মার মুক্তি নেই।
ঈশ্বরের বিধান একবার কর্মফল অনুযায়ী হবে আবার শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণকে কতটা দিচ্ছো তার উপর
ভিত্তি করে হবে,এটা হতে পারে কী?
একটা বৃহৎ
সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করে রাখতে,শোষন করতে ও দাস বানাতে জন্মান্তরবাদের জন্ম দিয়েছে
ব্রাহ্মণশ্রেনী।তোমার এই নিঃস্ব,বঞ্চিত,অবহেলিত, ঘৃণিত ও অত্যাচারিত জীবন তোমার পূর্ব
জন্মের পাপের ফল।এটাই ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রকারদের প্রচারিত জন্মান্তরবাদ আর এটাই
নাকি ঈশ্বরের বিধান।এমনই মানবতাহীন পাষন্ড ঈশ্বর হিন্দুদের।আসলে মানুষকে বোকা বানাতে নিজেদের তৈরী ষড়যন্ত্রকে ঈশ্বরের বিধান বলে
চালাচ্ছে ব্রাহ্মণশ্রেনী।
মানুষের সম্পদ লুঠ করার অসীম লোভ-লালোসা থেকে শ্রাদ্ধের জন্ম।ঠান্ডা মাথায় কী সুন্দর
পরিকল্পনা অন্যের সম্পদ জোর করে কাড়াকাড়ি নয়,চুরি,ডাকাতি নয়।মৃতব্যক্তির আত্মীয় স্বজন পরম ভক্তিতে-খাট,গদি,দুগ্ধবতীগাভী,পোশাক-আশাক,খাদ্যদ্রব্য,গহনা,চালডাল,ফলমূ্ল,জুতো,ছাতা,জমির দলিল................ইত্যাদি ব্রাহ্মণের বাড়ীতে গাড়ী ভাড়া করে পৌঁছে দেবে।যে
ব্যক্তি গরীব মানুষের মঙ্গলের জন্য এক পয়সা দেয় না সেই ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির
মঙ্গলের জন্য ব্রাহ্মণকে যথাসর্বস্ব দিয়ে দেয়,মিথ্যা স্বর্গের লোভে।অর্থাৎ ধর্মান্ধ ও শোকার্ত মানুষের সর্বস্ব লুঠ করার জন্য এক সুন্দর
গান্ধীবাদী অহিংস ডাকাতি হলো শ্রাদ্ধ।মিথ্যা শাস্ত্র ও মন্ত্র রচনা করে শ্রাদ্ধের
নামে দিনে ডাকাতি করছে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়।
জীবিত বাবা,মাকে যদি
সেবা-যত্ন না করে থাকো,বাবা মায়ের দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা যদি না করে থাকো কোনো
ব্যাপার নয়।বাবা/মায়ের মৃত্যূর পর ব্রাহ্মণকে দেখো,ব্রাহ্মণের সেবা করো,ব্রাহ্মণের
দুঃখ-কষ্ট,অভাব-অভিযোগ দূর করার চেষ্টা করো তাহলে শান্তি পাবে।এটাই শ্রাদ্ধ।
বর্নপ্রথা,জাতপাত
সৃষ্টি করে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় হিন্দুধর্মকে দূর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু করেছে।মৃত্যূর পরও
মানুষকে এরা জঘণ্য জাতপাত যুক্ত বর্ণপ্রথার বাইরে থাকতে দেয়নি।মৃত ব্যক্তিকে বর্ণপ্রথা
মেনে চলতে হয়।অর্থাৎ মৃত
ব্যক্তি ব্রাহ্মণের কথায় বর্ণধর্ম পালন করে।এ রকম চরম হাস্যকর ছেলেমানুষী ব্রাহ্মণদের।ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রকারদের মতে ব্রাহ্মণের আত্মা ১০দিন,ক্ষত্রিয়ের আত্মা
১৩ দিন,বৈশ্যের আত্মা ১৫দিন ও শূদ্রের আত্মা ৩০ দিন প্রেতদেহে কষ্ট পায়।ব্রাহ্মণকে
সন্তুষ্ট করে শ্রাদ্ধ করলে তবে এরা মুক্তি পাবে এবং স্বর্গে পাড়ি দেবে।শ্রাদ্ধ
করার আগে ব্রাহ্মনের কাছ থেকে জেনে নিন স্বর্গ,নরক ও প্রেতলোকের ঠিকানা।
শাস্ত্রে নারী
মাত্রেই শূদ্রানি।পিতামাতার মৃত্যূর ৩ দিন পর মেয়ে
শ্রাদ্ধ করবে এবং বর্ণ অনুযায়ী ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র চার বর্নের
পুত্ররা ১০/১৩/১৫/৩০ দিন পর শ্রাদ্ধ করবে।অর্থাৎ মৃত্যূর ৩দিন পর মৃত ব্যক্তির
আত্মা মেয়ের হাতে বামুনের মন্ত্রপুত পিন্ড খেয়ে স্বর্গে চলে যায় আবার ১০/১৩/১৫/৩০
দিন পর মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গ থেকে ছুটে আসে ছেলের হাতে বামুনের মন্ত্র পড়া চটকানো
পিন্ড খাবার জন্য।বামুনের মন্ত্রের যদি কোনো শক্তি থাকতো তাহলে বাড়ীতে বসে মানুষের
সম্পদ উড়িয়ে নিয়ে যেত।শ্রাদ্ধ নামক এমন ডাকাতির প্রয়োজন হতো
না।মন্ত্র,তন্ত্র,আশীর্বাদ,অভিশাপ সব বেকার,ধর্মান্ধ মানুষকে ঠকানো ছাড়া এসবের
কোনো মাহাত্ম নেই।
আর শ্রাদ্ধ না
করলে যদি আত্মার নরক প্রাপ্তি হয় তাহলে অপুত্রক ব্যক্তি,চিরকুমার,মঠ-মিশনের
সাধু সন্তের কী পরিনতি?সারা জীবন সৎকর্ম,সৎজীবন যাপন করে মানুষের সেবা করে কী তারা
সব নরকের যাত্রী।যাদের স্বর্গ,নরক,শ্রাদ্ধে বিশ্বাস তারা আত্মা বিশারদ ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা করুন উপরিলিখিত ব্যক্তিদের আত্মা কোথায় থাকছে।
খৃষ্টধর্ম
পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না।মুসলমানরা আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে
না।ইহুদীরা জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলে বিশ্বাস করে না।বৌদ্ধধর্ম আত্মা ও ঈশ্বরে
বিশ্বাস করে না।যীশু,মোহাম্মদ,বদ্ধদেব এদের সবার কথা কী মিথ্যা?শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের
কথা কী ঠিক?পৃথিবীর কোনো ধর্মে জন্মান্তর ও কর্মফল অনুসারে পূর্বজন্মের কর্মফল
লাভের কথা নেই।ব্রাহ্মণরা বুঝেছিলো যে শূদ্রদের পুনর্জন্ম ও কর্মফলের আশায় ভুলিয়ে
রাখতে পারলে ওরা কোনো দিন বিদ্রোহ করবে না।সব সামাজিক বৈষম্যকে এরা পুর্বজন্মের
কর্মফল বলে মেনে নেবে।হয়েছেও তাই ভারতের শূদ্রশ্রেনী,যত বঞ্চনা,অবিচা্র,অত্যাচারকে
পূর্বজন্মের কর্মফল বলে মেনে নিয়েছে।
আসলে আত্মা একটি
কাল্পনিক বিষয়।মৃত্যূর পর সবকিছু শেষ হয়ে গেল এটা মানুষ মানতে পারেনি।তাই আত্মার
ভাবনা।বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের আত্মার ভাবনা ভিন্ন।আত্মা্,স্বর্গ,নরক
ও ঈশ্বর ভাবনায় কোনো ধর্মের সাথে কোনো ধর্মের মিল নেই।কারন এসব কাল্পনিক,সব মনগড়া ব্যাপার।পৃথিবীর যে অঞ্চলে মানুষ বাস করে সেখানকার পরিবেশ,পরিস্থিতি,জীবন,জীবিকা
প্রাপ্ত-অপ্রাপ্তি এসবের উপর নির্ভর করে আত্মা,স্বর্গ,নরক ও ঈশ্বর ভাবনা।পৃথিবীর
সব জায়গায় তো আর এক রকম অনুকূল পরিবেশ নয়, তাই মানুষের ভাবনা ও স্বপ্ন এক হতে পারে
না।
ভারতে ব্রাহ্মন্যবাদীরা যেভাবে আত্মাকে নিয়ে ব্যাবসা করছে তা পৃথিবীতে বিরল।আত্মার অবিনশ্বরতার উপর
ভিত্তি করে স্বর্গ-নরক,পাপ-পূণ্য,পরজন্ম ও কর্মফলের সৃষ্টি।এসব কাল্পনিক বিষয়ে
মানুষের অন্ধবিশ্বাস যতদিন না দূর হবে ততদিন মানুষ ব্রাহ্মণের হাতে ঠকতে থাকবে।
গান্ধীজি
বলেছিলেন- “ব্রাহ্মণদের সুমতি হলে বর্ন প্রথা উঠে যাবে”।এ কী কোনো দিন সম্ভব?এদের সুমতি
কোনোদিন হবে না কারন কেউ নিজের পায়ে কুড়ুল মারে না।সুমতি হলে তো খেটে খেতে হবে।এদের
সুমতি হলেই তো সব ধর্মগ্রন্থ ফেলে দিতে হবে।কারন সব ধর্মশাস্ত্রগ্রন্থের মেরুদন্ড
তো বর্নপ্রথা।আর বিনা পরিশ্রমে অন্যের সম্পদ ভোগ করা কি কম আনন্দের।
চার্বাক পন্ডিত
মাধবাচার্য বলেছেন-“স্বর্গ-নরক নেই,পারলৌকিক আত্মা নেই,বর্নাশ্রমাদির ক্রিয়া নিষ্ফলা।অগ্নিহোত্র
তিনবেদ(ঋক,সাম ও যজু),ত্রিদন্ড,ছাইভস্ম লেপন,বুদ্ধিহীন ও পৌরুষহীন,নিষ্কর্মা
মানুষের জীবিকার উপায় মাত্র”।
স্বামী
বিবেকানন্দ বলেছিলেন-“মৃত্যূর পর মানুষ স্বর্গে যায়
এটা কল্পনা মাত্র।সজ্জন ব্যক্তি মৃত্যূর পর স্বর্গে গিয়ে অনন্ত সুখময় জীবন যাপন
করে-এ ধারনা স্বপ্ন মাত্র।স্বর্গ ও নরক এসব আদিম ধারনা”।(বানী ও রচনা-দশম খন্ড-পৃষ্ঠা ১৫৯)
তাই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান
নয়,শ্রদ্ধা অনুষ্ঠান করুন।নাপিত,ব্রাহ্মণ নয়,আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে।
PRASANTA KUMAR MONDAL
ঃব্যক্তিগত মতামতঃ
|
No comments:
Post a Comment