রামমোহন(১৭৭২-১৮৩৩),বিদ্যাসাগর(১৮২০-১৮৯১),বিবেকানন্দ(১৮৬৩-১৯০২)।এই তিন জনের মধ্যে
সাক্ষাৎ হলে যে কথোপকথন হতো।(জন্ম-মৃত্যূ সাল দেখুন,এঁদের মধ্যে সাক্ষাৎ কিন্তু অসম্ভব)।
@Prasanta Kumar Mondal
রামমোহনঃ ধর্মগ্রন্থ এবং
শাস্ত্রগ্রন্থ সমূহের সাহায্যে শাস্ত্রকারেরা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
বিদ্যাসাগরঃ যথার্থ বলেছেন।
বিবেকানন্দঃ মানতে পারলাম না।
রামমোহনঃ কেন হে ছোকরা,তুমি মানতে পারছো না কেন?
বিবেকানন্দঃ কারণ সমাজের মঙ্গলের জন্য এবং পরিচালনায় ধর্মশাস্ত্র আমাদের
বড় সহায়।
রামমোহনঃ ধর্মশাস্ত্র কিন্তু জাতিভেদের বিধান দিয়েছে,নারীদের বাল্যবিবাহের
বিধান দিয়েছে।আর বিধবা নারীদেরকে সতী করার নামে পুড়িয়ে মারার বিধান দিয়েছে।এসব কি
সমাজের মঙ্গলের জন্য?
বিবেকানন্দঃ জাতিবিভাগ আছে বলে ৩০ কোটি মানুষ এখনো
এক টুকরো রুটি পাচ্ছে।আমি সব জাতকে একাকার করতে বলি না।জাতিবিভাগ খুব ভালো।
বিদ্যাসাগরঃ আর বাল্যবিবাহ?
বিবেকানন্দঃ বাল্যবিবাহ হিন্দুজাতিকে পবিত্রতায়
ভূষিত করেছে।
রামমোহনঃ আর সতীদাহ?
বিবেকানন্দঃ মৃত্যূর পর সতীরা অমরলোকে প্রস্হান করে।
বিদ্যাসাগরঃ ওরে পাগলা স্বর্গ-নরক,মরলোক-অমরলোক সব
এখানেই,এই পৃথিবীতে।
রামমোহনঃ তাহলে তুমি বলতে চাও নারীদের বাল্যকালে বিয়ে দেওয়া এবং
বিধবা হলে পুড়িয়ে মারা সমাজের ভালোর জন্য।
বিবেকানন্দঃ ধর্মশাস্ত্রের বিধান মানুষের মঙ্গলের
জন্য।
বিদ্যাসাগরঃ বাল্যবিবাহ দিয়ে সমাজের কি উপকার
হচ্ছে?বিধবা নারীরা সমাজে দুঃখের সাগরে পতিত হচ্ছে না কী?
বিবেকানন্দঃ মেয়েদের প্রনয়প্রবৃত্তি জাগ্রত হওয়ার
আগে বিয়ে না দিলে সমস্যা।কারণ ভালোবাসার মাধ্যমে পতি-পত্নী নির্বাচনের ফলে
পাশবপ্রবৃত্তি সফল হবে এবং দুষ্ট-অসুর প্রকৃতির সন্তান জন্ম
নেবে।
রামমোহনঃ তুমি করবে না ঠিক আছে।কিন্তু যুবক-যুবতীদের প্রেম-ভালোবাসা
আটকাতে তুমি মিথ্যা ভয় দেখাতে পার কী?
বিবেকানন্দঃ আপনাদের বয়স হয়েছে।সমাজের ভাবনা আর না
ভাবলে চলবে।
বিদ্যাসাগরঃ শুনেছি তোমার গুরু নাকি নারীকে সহ্য
করতে পারেন না?নারীদের প্রতি এই মনোভাব কি গুরুর প্রভাবে?
বিবেকানন্দঃ আপনাকে গুরুদেব দক্ষিনেশ্বরে যেতে
অনুরোধ করেছিলেন।আপনি যাননি।গেলে তিনি কেমন যানতে পারতেন।নারীর প্রতি আমার মনোভাব
খারাপ নয়।তার প্রমান হল সংসার ছাড়লেও আমি সন্তানের ধর্ম পালন করে চলেছি।
রামমোহনঃ আমি কিন্তু সতী করার নামে বিধবা নারীকে পুড়িয়ে মারার
শাস্ত্রীয় বিধান মানতে পারিনি।দেশের মানুষকে বোঝাতে পারিনি।ইংরেজ সরকার আমার
আবেদনে সাড়া দিয়ে সতীদাহ বিরোধি আইন পাশ করেছেন।
বিদ্যাসাগরঃ আমিও ইংরেজ সরকারের সাহায্যে বিধবা
নারীদের পুনর্বিবাহের আইন পাশ করিয়েছি।
বিবেকানন্দঃ সতীদাহ প্রথা তুলে আর বিধবাদের
পুনর্বিবাহ দিয়ে আমার যুবসমাজের কি উপকার হল?
রামমোহনঃ ওহে ছোকরা,মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিলে আর বিধবাদের সতী করে
পুড়িয়ে মারলে তোমার সমাজের যোগ্য যুবসমাজ কে তৈরী করবে?শিক্ষিত মা ছাড়া শিক্ষিত
যুবসমাজ তৈরী হয় কী?
বিবেকানন্দঃ বাল্যবিবাহ দেয় এমন লোককে আমি খুন
পর্যন্ত করতে পারি।
বিদ্যাসাগরঃ এই তো বীরের মত কথা।
বিবেকানন্দঃ কিন্তু জন্ম থেকেই শিশু হয় দেব না হয়
দানব।ইহাই শাস্ত্রের বিধান।
রামমোমনঃ ওহে ছোকরা,তুমি আমাদের শাস্ত্র শেখাতে এসো না।
বিদ্যাসাগরঃ শিশু জন্ম থেকে যদি দেব বা দানব হয়
তাহলে শিশুদের জন্য লেখা আমার বর্ণপরিচয়,আদর্শলিপি সব বেকার হল কী?তুমি কি বলতে
চাও?
বিবেকানন্দঃ না না আমি তা বলছি না।আমি বলতে চাইছি
শিশু বটবৃক্ষের বীজের মত তাকে লালন,পালন করে বিকশিত করা শিক্ষকের কাজ।
বিদ্যাসাগরঃ আমার কাছে কিন্ত খবর আছে,তুমি আমার
বিধবাবিবাহ প্রচলনকে কটুক্তি করেছো এবং আমার লেখা বই গুলিকে মন্দবই বলেছো।
বিবেকানন্দঃ লজ্জা দেবেন না।
রামমোহনঃ ওহে ছোকরা,তুমি কি টেনশনে আছ?
বিবেকানন্দঃ কেন বলুন তো?
রামমোহনঃ তুমি বলছো বাল্যবিবাহ ভালো,আবার বলছো বাল্যবিবাহ দেয় তাকে
খুন পর্যন্ত করতে পার,জন্ম থেকেই শিশু হয় দেব না হয় দানব বলছো আবার শিক্ষকের
প্রয়োজন বলছো।এমন পাল্টি খাচ্ছ কেন?
বিবেকানন্দঃ আমার মতে জাতিবিভাগ খুব ভালো।ভারতে ব্রাহ্মণই
চরম আদর্শ।ব্রাহ্মণদের মধ্যেই অধিকতর মনুষত্ব সম্পন্ন মানুষের জন্ম হয়।জ্ঞানোন্মেষ হলেও
কুমোর কমোরই থাকবে।আমি মনে করি এবং মানি যে সমাজ সংস্কার ধর্মের কাজ নয়।
বিদ্যাসাগরঃ তুমি খুব চালাক।তুমি পরিবেশ পরিস্হিতি
অনুযায়ী যে ঢাক বাজাও তা প্রমানিত হল।আমরা দুজন ব্রাহ্মণ তাই কি তুমি ব্রাহ্মদের
ঢাক পেটাচ্ছো?
রামমোহনঃ তুমি বলছো সমাজ সংস্কার ধর্মের কাজ নয়।ধর্মমতে তুমি সমাজ
চালাতে চাও।তাহলে ধর্মের আবর্জ্জনা হঠাবে কে?
বিবেকানন্দঃ সময় হলে সব হবে।গীতা ও বেদান্তের উপর যে
সমস্ত ভালো ভালো বই আছে,শুধু সেগুলি পড়লে সমাজের ভালো হবে।
বিদ্যাসাগরঃ সময় হলে সব হবে?এই বোকা বানানো কথা তো
শতশত বছর ধরে ধর্মীয় নেতারা বলে আসছে।মানুষকেই তো সব করতে হচ্ছে এবং হবে।
রামমোহনঃ তবে ছোকরা,তোমার শ্লোগানগুলি শুনতে খুব
ভালো।যেমন-‘হিন্দুধর্ম পৈশাচিক ভাবে গরীব ও পতিতের গলায় পা দিয়েছে,’পুরোহিততন্ত্র
ভারতবিধ্বংসী বিষ’,’পুরোহিততন্ত্র ভারতের সর্বনাশের মূল’,‘ভগবান নয় দরিদ্রনারায়ণ সেবাই
ধর্ম’,জীবে প্রেমই ঈশ্বর প্রেম’,‘হিন্দুরা বেদান্ত মতে মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে,আবার
সেই মানুষকে পশুজ্ঞান করে’,‘নারীর
উন্নতি ছাড়া সমাজ উন্নত হবে না’ প্রভৃতি।
বিদ্যাসাগরঃ তুমি এমন স্ববিরোধি কেন?
বিবেকানন্দঃ কোথায়?
বিদ্যাসাগরঃ তুমি বাল্যবিবাহের পক্ষে আছো আবার
বিপক্ষেও আছো,নারী জাতির উন্নতি চাও আবার তাদের সীতা-সাবিত্রী বানাতেও চাও,শিশুকে
দেব বা দানব বলছো আবার শিক্ষকের ভূমিকা মহান বলছো,জঘণ্য জাতিবিভাগকে ভালো বলছো
আবার জাতের নামে বজ্জাতিকে খারাপ বলছো।শূদ্রের জন্য কাঁদছো আবার
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়কে মহান বলে প্রশংসা করছো।জীব প্রেমের কথা বলছো আবার ‘বরাহনগর
মঠে’ পশুবলীর প্রবর্তন করলে আবার বেলুড় মঠের দূর্গাপূজায় তোমার পাঁঠাবলীর
সিদ্ধান্ত সারদামণী বাতিল করলো।এসব দ্বিচারিতা এবং স্ববিরোধিতা নয় কী?
বিবেকানন্দঃ এমন স্ববিরোধি অনেকেই আছেন।
রামমোহনঃ তুমি কাকে বলছো?আমাকে বলছো না তো?
বিবেকানন্দঃ হ্যাঁ,আপনাকে বলছি।আপনি ব্রাহ্মধর্ম
তৈরী করলেন কিন্তু ব্রাহ্মণের পৈতা তো ছাড়তে পারলেন না।আপনার প্রার্থনা সভায় নিচুজাতের মানুষের প্রবেশ নিষেধ ছিলো।বিদেশ যাত্রায় আপনি ব্রাহ্মণ পাচক সঙ্গে নিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরঃ সেই যখন ব্রাহ্মণ্যবাদ ছেড়ে ব্রাহ্মধর্ম
বানালেন তখন জাতিভেদের চিহ্ন পৈতা আপনার ছাড়া উচিত ছিলো।
রামমোহনঃ আপনি ছেড়েছেন?
বিদ্যাসাগরঃ না।
রামমোহনঃ আপনি ছেড়েছেন?
বিদ্যাসাগরঃ না।
রামমোহনঃ তুমি
বলছো সমাজ সংস্কার ধর্মের কাজ নয়।তাহলে ধর্মীয় নেতা হিসাবে তোমার কাজ কী?
বিবেকানন্দঃ সমাজের সার্বিক উন্নতি।
বিদ্যাসাগরঃ সে কি বেদ-বেদান্ত পাঠ করে হবে?
বিবেকানন্দঃ না,যুবসমাজকে সার্বিক বিকাশের শিক্ষা
দিতে হবে।
রামমোহনঃ তাহলে ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা সতীদাহ,জাতিভেদপ্রথা ও
নারীদের প্রতি ধর্মশাস্ত্রের কুটীল নির্দেশের বিরুদ্ধে তোমার কিছু বলার নেই।
বিবেকানন্দঃ না।
রামমোহনঃ পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম ও ধর্মীয় নেতা
সংস্কারের বিরোধি।
@Prasanta Kumar Mondal
No comments:
Post a Comment